
টাটা স্টিল ট্রেইলব্লেজার্স ক্রীড়া সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশনটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক। এবারের বিষয় ছিল ‘মেনার্ক থেকে মেনোপজ’—অর্থাৎ ঋতুস্রাবের শুরু থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত মহিলা ক্রীড়াবিদদের জীবনের একটি স্পর্শকাতর এবং গুরুতর বিষয় (Menstrual Challenges in Sports)। এটি এমন একটি সমস্যা, যা নিয়ে মহিলা ক্রীড়াবিদরা সাধারণত খোলাখুলি কথা বলতে চান না। তবুও তারা এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়ে মাঠে নিজেদের সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে চলেছেন।
এই অধিবেশনের সঞ্চালনা করেছেন রেভস্পোর্টজ-এর শর্মিষ্ঠা গুপ্ত। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অলিম্পিক পদকজয়ী মীরাবাঈ চানু এবং লভলিনা বরগোহাঁই। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ডা. স্বাতি মিশ্র, বিএসভি-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ভাবনা সিং এবং ফুড অ্যান্ড ওয়েলনেস-এর প্রতিষ্ঠাতা মিনু আগরওয়াল। এই প্যানেলে মহিলা ক্রীড়াবিদদের জীবনে ঋতুস্রাব এবং তার প্রভাব নিয়ে গভীর আলোচনা হয়েছে।
মহিলা ক্রীড়াবিদদের জন্য ঋতুস্রাবের চ্যালেঞ্জ
মহিলা ক্রীড়াবিদদের জন্য ঋতুস্রাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সময়ে শরীরে নানা পরিবর্তন হয়, যা তাদের পারফরম্যান্সের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবুও তারা এই কঠিন পরিস্থিতি মেনে নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং সাফল্য অর্জন করেন। সম্প্রতি ক্রীড়াপ্রেমীরা এই বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। সঞ্চালক শর্মিষ্ঠা ক্রীড়াবিদদের প্রশ্ন করেন, ঋতুস্রাব তাদের পারফরম্যান্সে কীভাবে প্রভাব ফেলে?
২০২১ সালে টোকিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী বক্সার লভলিনা বরগোহাঁই বলেন, “ঋতুস্রাবের সময় শরীর ভেঙে পড়ে। আমাদের নিজেদের সামলে রাখতে হয়। পেটে ব্যথা হয়, সারা শরীরে ব্যথা থাকে। তবুও এই কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মানসিক চাপ থাকে। এই সময় মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হয়। সম্প্রতি আমি যোগব্যায়াম শুরু করেছি, এটি আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এনেছে। আমি সবাইকে এটি করার পরামর্শ দেব।”
একইভাবে, ২০২১ সালে টোকিও অলিম্পিকে ওয়েটলিফটিং-এ রুপোর পদকজয়ী মীরাবাঈ চানু তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, “টোকিও অলিম্পিকের সময় আমি ঋতুস্রাবের দ্বিতীয় দিনে ছিলাম। আমাকে আমার কোচের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলতে হয়েছিল। শরীরে খিঁচুনি ছিল, ব্যথা ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও থেকে লড়তে হয়।”
স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতার অভাব
বিএসভি-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ভাবনা সিং বলেন, “মহিলারা নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি যথেষ্ট যত্ন নেন না। আমরা আমাদের স্বাস্থ্যকে অবহেলা করি। এটি আমাদের আচরণগত সমস্যা। আমরা ডাক্তারের কাছে যাই না। একটি মহিলা স্বাস্থ্য সংস্থার অংশ হিসেবে আমি মনে করি, এই ধরনের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কোম্পানিতে আমরা ঋতুস্রাবের জন্য ছুটি দিই।” তিনি জানান, এই ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে মহিলাদের স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
ডা. স্বাতি মিশ্র বলেন, “এই বিষয়ে শিক্ষার মাত্রা বাড়ছে। মানুষ এখন এটা নিয়ে কথা বলছে। তবুও এখনও একটা লজ্জা বা ট্যাবু রয়ে গেছে। আমরা এখনও পুরোপুরি এটাকে মেনে নিতে পারিনি। আমাদের কাজ হলো মানুষকে বোঝানো যে এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সচেতনতা ধীরে ধীরে বাড়ছে।”
ট্যাবু ভাঙার প্রয়োজন
ফুড অ্যান্ড ওয়েলনেস-এর প্রতিষ্ঠাতা মিনু আগরওয়াল বলেন, “এটি শুধু গ্রামে নয়, মেট্রো শহরেও একটি ট্যাবু। আমরা বাবা, ভাই বা পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলি না। একজন ক্রীড়াবিদের শরীর অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যায়। মানসিক চাপ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। আমাদের ক্রীড়াবিদদের এটা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত এবং কীভাবে এটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, তা শেখানো দরকার।”
মহিলা ক্রীড়াবিদদের সংগ্রাম
এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে মহিলা ক্রীড়াবিদদের জন্য ঋতুস্রাব শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। লভলিনা এবং মীরাবাঈয়ের মতো অলিম্পিক পদকজয়ীরা যখন এই বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেন, তখন এটি অন্যদের জন্যও প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। তাঁদের কথায় বোঝা যায়, এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্যেও কীভাবে তারা নিজেদের মানসিক শক্তি দিয়ে লড়াই চালিয়ে যান।
সমাজে পরিবর্তনের প্রয়োজন
এই অধিবেশনটি শুধু ক্রীড়াবিদদের জন্য নয়, সাধারণ মহিলাদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে। ঋতুস্রাব নিয়ে যে লজ্জা বা গোপনীয়তা রয়েছে, তা ভাঙতে হবে। শিক্ষা, সচেতনতা এবং খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে এটি সম্ভব। ভাবনা সিং-এর কথায়, মহিলাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে। ডা. স্বাতি এবং মিনু আগরওয়ালও একমত যে এই বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সময় এসেছে।
টাটা স্টিল ট্রেইলব্লেজার্সের এই অধিবেশনটি মহিলা ক্রীড়াবিদদের জীবনের একটি অজানা দিক তুলে ধরেছে। মীরাবাঈ এবং লভলিনার মতো তারকাদের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত এই আলোচনাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এটি ক্রীড়া জগতের পাশাপাশি সমাজের জন্যও একটি শিক্ষণীয় পাঠ। ঋতুস্রাবকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা এবং এটি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা এখন সময়ের দাবি।