
ভারতীয় হকির পুনর্জাগরণ (Future of Indian Hockey) উদযাপন করতে রেভস্পোর্টজ আয়োজিত টাটা স্টিল ট্রেইলব্লেজার্স ক্রীড়া সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের শেষ অধিবেশনটি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ‘ভারতীয় হকির উদযাপন’ শিরোনামে এই অধিবেশনটির সঞ্চালনা করেন রেভস্পোর্টজের সম্পাদক বোরিয়া মজুমদার। এতে অংশ নিয়েছিলেন হকির কিছু বড় নাম—পিআর শ্রীজেশ, হরমনপ্রীত সিং, হকি ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট দিলীপ টিরকি, সেক্রেটারি ভোলানাথ সিং, ভারতীয় মহিলা দলের কোচ হরেন্দ্র সিং এবং শ্রাচি গ্রুপের এমডি ও শ্রাচি রড় বেঙ্গল টাইগার্সের মালিক রাহুল টোডি।
সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প, অভিজ্ঞতার কাহিনী দিয়ে এই প্যানেল হকির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার বার্তা দিয়েছে। টানা দুটি অলিম্পিক ব্রোঞ্জ পদক এবং ভবিষ্যতের পথচলা—এই অধিবেশনে অনেক কিছুই উঠে এসেছে।
দিলীপ টিরকির আক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি
ভারতীয় হকির কিংবদন্তি ডিফেন্ডার দিলীপ টিরকি বলেন, খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিক পদক না জেতাই তাঁর জীবনের বড় আক্ষেপ। তিনি বলেন, “কিন্তু হকি ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি সঠিক জায়গায় ফোকাস করার চেষ্টা করছি। আমরা যে কোনো দলকে হারাতে পারি, এবং আমরা যা করছি তা ভালো। এগিয়ে যেতে আমরা জুনিয়র এবং মহিলা দলকে সেরা সুযোগ-সুবিধা দিতে চাই। এফআইএইচ প্রো লিগে মহিলা দলের নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে জয় একটি বড় মুহূর্ত। আমরা এটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।” টিরকির কথায় ভারতীয় হকির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা জাগে।
শ্রীজেশের অভিজ্ঞতা
জনপ্রিয় গোলকিপার পিআর শ্রীজেশ, যিনি এখন জুনিয়র জাতীয় দলের কোচ, বলেন, ২০২১ এবং ২০২৪ সালের সাফল্যের ভিত্তি আগেই তৈরি হয়েছিল। তিনি বলেন, “লন্ডন এবং রিও ডি জেনিরোতে আমাদের হারের সময়ই এর ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করেছে। সেই পরাজয়গুলো আমাদের এগিয়ে যেতে প্রेरণা দিয়েছে। সেখান থেকে পাওয়া শিক্ষা অমূল্য।” শ্রীজেশের কথায় বোঝা যায়, ব্যর্থতা কীভাবে সাফল্যের পথ দেখায়।
বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন
হকি ইন্ডিয়ার সেক্রেটারি ভোলানাথ সিং বলেন, তাঁদের স্বপ্ন বিশ্বকাপ জয়। তিনি জানান, “এটা শুধু আমার ধারণা নয়, এটি একটি সমষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা বড় ইভেন্ট—অলিম্পিক, বিশ্বকাপ এবং এশিয়ান গেমসে দক্ষতা অর্জন করতে চাই। খেলোয়াড়দের সব সুবিধা দেওয়া হবে। আমি নিজে একজন কুস্তিগীর এবং কোচ। আমি বুঝি খেলোয়াড়, কোচ এবং দলের কী প্রয়োজন। আমরা হকি ইন্ডিয়া লিগকে বিশ্বের সেরা লিগ বানাব।” ভোলানাথের এই প্রতিশ্রুতি ভারতীয় হকির উন্নতির জন্য বড় আশা জাগায়।
হরমনপ্রীতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা
জাতীয় দলের অধিনায়ক এবং চ্যাম্পিয়ন ড্রাগ-ফ্লিকার হরমনপ্রীত সিং বলেন, ব্রোঞ্জ শুধু শুরু। তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, আমরা সোনার পদক জিততে পারি। এটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। আমরা দেখেছি আমরা কী করতে পারি। এখন আমাদের মান আরও বাড়াতে হবে। আমাদের বিশ্বের সেরা হওয়ার ক্ষমতা আছে। যতক্ষণ না তা হয়, আমি সন্তুষ্ট নই।” হরমনপ্রীতের এই আত্মবিশ্বাস ভারতীয় হকির ভবিষ্যৎ নিয়ে সমর্থকদের মনে উৎসাহ জাগায়।
হরেন্দ্রর সন্তুষ্টি
মহিলা দলের কোচ হরেন্দ্র সিং বলেন, হকি ইন্ডিয়া কোচদের জন্য পরিবেশ উন্নত করেছে। তিনি জানান, “হকি ইন্ডিয়া থেকে আমি যা পাই, বিদেশি কোচরাও তাই পান। এখানে কোনো বৈষম্য নেই। আমি মহিলা দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হইনি। কাজের পরিবেশ দারুণ। এখন ফল দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।” হরেন্দ্রর এই মন্তব্য হকি ইন্ডিয়ার প্রশাসনিক উন্নতির ইঙ্গিত দেয়।
লিগের ভূমিকা
শ্রাচি রড় বেঙ্গল টাইগার্সের মালিক রাহুল টোডি, যাঁর দল হকি ইন্ডিয়া লিগ জিতেছে, বলেন, “দলের মালিক হিসেবে আমার লক্ষ্য ছিল খেলোয়াড়দের জন্য জিনিসগুলো ভালো করা। তারাই আসল চ্যাম্পিয়ন। আমরা দল গড়েছি এবং ভালো বিকল্প রেখেছি। তারপর এটি দল ও খেলোয়াড়দের প্রতিশ্রুতির ফল। আশা করি, লিগটি খেলোয়াড়দের হকিতে ফিরিয়ে আনবে এবং মান উন্নত করবে।” টোডির এই উদ্যোগ বাংলার হকিপ্রেমীদের জন্য গর্বের বিষয়।
ভারতীয় হকির পুনর্জাগরণ
২০২১ এবং ২০২৪ সালে টোকিও ও প্যারিস অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয় ভারতীয় হকির পুনরুত্থানের প্রমাণ। একসময় হকিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন দলটি আবার শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শ্রীজেশের কথায়, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এই সাফল্য এসেছে। হরমনপ্রীতের সোনার স্বপ্ন এবং টিরকির নেতৃত্বে হকি ইন্ডিয়ার পরিকল্পনা ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী করে।
বাংলার প্রেক্ষাপট
বাংলায় হকির জনপ্রিয়তা বাড়াতে শ্রাচি রড় বেঙ্গল টাইগার্সের সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ। রাহুল টোডির উদ্যোগ নতুন প্রজন্মকে হকির প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচে ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স বাংলার সমর্থকদের জন্যও বিশেষ আগ্রহের বিষয়।
টাটা স্টিল ট্রেইলব্লেজার্সের এই অধিবেশন ভারতীয় হকির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি সমৃদ্ধ আলোচনা উপহার দিয়েছে। শ্রীজেশের অভিজ্ঞতা, হরমনপ্রীতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, টিরকি ও ভোলানাথের প্রতিশ্রুতি এবং হরেন্দ্রর আত্মবিশ্বাস ভারতীয় হকির জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখায়। হকি ইন্ডিয়া লিগের মাধ্যমে এই খেলার মান বাড়লে, বাংলাসহ সারা ভারতে হকির জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।